বেড়ায় বিপন্ন গন্ধগোকুলের টিকে থাকার লড়াই
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
১৩-০৫-২০২৫ ০৩:৫৬:৪১ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১৩-০৫-২০২৫ ০৩:৫৬:৪১ অপরাহ্ন
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অনেক এলাকা থেকেই গন্ধগোকুল হারিয়ে গেছে। কিন্তু পাবনা বেড়া পৌর এলাকার মৈত্রবাঁধা, শেখপাড়া, দাসপাড়া, হাতিগাড়াসহ কয়েকটি মহল্লায় এখনও এদের বিচরণ চোখে পড়ে। তবে আগের চেয়ে সংখ্যা বেশ কমেছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) তালিকা অনুযায়ী এরা ‘বিপদাপন্ন’ প্রাণী।
প্রাণীটির আসল নাম গন্ধগোকুল হলেও বেড়া পৌর এলাকায় এটি ‘নেল’ নামে পরিচিত। অনেকে এদের বাগডাশও বলেন। এদের শরীর থেকে পোলাও চালের মতো তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। সন্ধ্যার পর অন্ধকার নামলে পৌর এলাকার বিভিন্ন বাড়ির ঘরের চাল ও গাছের ওপর দিয়ে শুরু হয় এদের যাতায়াত। যাতায়াতের সময় এদের শরীরের গন্ধ উৎপাদনকারী গ্রন্থি থেকে রস নিঃসৃত হতে থাকে বলে যে স্থান দিয়েই এরা যাক না কেন বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত সেখানে পোলাওয়ের চালের তীব্র গন্ধ নাকে আসে। তখন পৌরবাসী বুঝতে পারেন, আশেপাশে হয়তো গন্ধগোকুল রয়েছে অথবা একটু আগেই এই স্থান দিয়ে কোথাও চলে গেছে।
দীর্ঘদিন ধরেই গন্ধগোকুল বা নেল নামের প্রাণীটির সঙ্গে বেড়া পৌরবাসীর সম্পর্ক রয়েছে। বেশির ভাগ পৌরবাসীর কাছেই প্রাণীটি বেশ পছন্দের। তবে অল্প কিছু মানুষ এদের অপছন্দ করেন গৃহপালিত হাঁস-মুরগি, কবুতর চুরি করে নিয়ে যাওয়ার কারণে। গত ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে পৌরবাসী এই প্রাণীটিকে ফাঁদ পেতে ধরেছেন বা এগুলোর কোনো ক্ষতিসাধন করেছেন বলে শোনা যায়নি।
বেড়া উপজেলার মনজুর কাদের মহিলা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, ‘গন্ধগোকুল হলো প্রকৃতির উপকারী একটি নিশাচর প্রাণী। এরা ব্যাঙ, ইঁদুরসহ ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধিতে দারুণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমাদের অজ্ঞানতার কারণে আমরা এ প্রাণীটির জীবনকে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছি। একসময় এদের দেশের প্রায় সর্বত্রই বনাঞ্চল বা বন সংলগ্ন ঝোপঝাড়, গ্রামাঞ্চলে দেখা যেত। তবে এখন এরা বিলুপ্তির পথে। এরা তাল, খেজুরের রস পান করে, ইঁদুর, ছোট পাখি, পোকামাকড় প্রভৃতি খেয়ে জীবনধারণ করে। কিন্তু কখনও কখনও এরা মানুষের গৃহপালিত হাঁস-মুরগি, কবুতর ধরে নিয়ে যায় বলে মানুষ এদের ফাঁদ পেতে ধরে হত্যা করে। আবার অনেক সময় রাস্তা পারাপারের সময় দুর্ঘটনায়ও মারা যায়। এর ফলে এদের অস্তিত্ব কিছুটা হুমকির মুখে। এদের বিপদাপন্ন বলা যেতে পারে। তবে আমাদের এলাকায় এদের বিচরণ যেমন কিছুটা বেশি তেমনি পৌরবাসীও এদের প্রতি সহানুভূতিশীল।’
একই কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বেড়া পৌর এলাকার দক্ষিণপাড়া মহল্লার বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ জানান, প্রায়ই তাঁর বাড়ির গাছ ও ছাদের ওপর দিয়ে প্রাণীটি সন্ধ্যার পর যাতায়াত করে থাকে। মায়াবী প্রাণীটির প্রতি অজানা কারণে তাঁর বেশ সহানুভূতি রয়েছে। তাই কৌতুহলের কারণে তিনি এই প্রাণীটি সম্পর্কে পড়াশোনা করেছেন। তিনি জানান, পরিবেশে গন্ধগোকুলের বিশেষ এক ভূমিকা রয়েছে। খাদ্যশৃংখলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান তার। মূলত এরা কৃষির ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে এবং ফলমূল খেয়ে এর বীজ বিস্তারের মাধ্যমে পরিবেশের প্রচুর উপকার সাধন করে থাকে। যেমন- বটফল বা অন্যান্য ফল তারা যখন খায় তখন এর মলের দ্বারা নির্গত সেই বীজগুলো সফল উদ্ভিদে পরিণত হয়। অর্থাৎ এর পেটের ভেতর দিয়ে ফলের বীজগুলো গজানোর উপযুক্ত পরিবেশ (জার্মিনেশন) পায় বলে তা পরবর্তীতে বীজের অংকুরোগদমে শতভাগ কার্যকরী হয়ে থাকে। তিনি আরও জানান, বছরে সাধারণত দু’বার এরা প্রজনন করে। গর্ভধারণকাল দুই মাসের কিছু বেশি। পুরনো গাছের খোঁড়ল, গাছের ডালের ফাঁকে, পরিত্যক্ত ঘর, ধানের গোলা বা তাল-সুপারির আগায় ছানা তোলে। সাধারণত প্রতিবার ছানা হয় তিনটি।
বেড়া পৌর এলাকার মৈত্রবাঁধা মহল্লার অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক শিখা রাহা বলেন, ‘আমার বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই এরা যাতায়াত করে। আমার ধারণা আমার বাড়ির আশেপাশের কোনো গাছে বা পরিত্যক্ত ঘরে এরা বাস করে। সন্ধ্যার পর ছাদে গেলেই অনেক সময় পর্যন্ত এদের গায়ের পোলাউয়ের গন্ধ পাই। কখনও কখনও এদের দুই-তিনটিকে যাতায়াত করতেও দেখি। তিন-চারমাস আগে আমার ছাদবাগানের ঝোপের মধ্যে দুটি বাচ্চাকেও দেখেছিলাম। দুই-তিনদিন পর আর দেখতে পাইনি। সম্ভবত ওদের মা অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল।’
বেড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাগডাশ বা গন্ধগোকুল মানুষের কাছাকাছি থাকে, কিন্তু মানুষকে দেখে খুবই ভয় পায়, খুবই লাজুক স্বভাবের। আবাসভূমি ধ্বংস ও হাঁস-মুরগি বাঁচানোর জন্য ব্যাপক নিধনের কারণে এরা এখন বিপন্ন। তবে এরা কিন্তু প্রকৃতির বন্ধু। তাই সবারই উচিত এদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া।’
এবিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় বণ্যপ্রানী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবীর জানান, গ্রামীণ বন বিলুপ্ত হওয়ার ফলে তাদের আবাসস্থল কমে যাচ্ছে। যে কারণে এরা মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। তবে এ প্রাণীটি মানুষের কোন ক্ষতি করে না। খাবারের অভাবে হয়তো হাঁস-মুররি বাচ্চার উপর আক্রমণ করে। তবে গন্ধগকুল রক্ষার্থে মানুষের সচেতন হওয়াটাই জরুরি বিষয়।
বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স